
প্রতিনিধি:‘দেখো আমি বাড়ছি মামি’…
সন্তান সত্যিই ঠিকঠাক বাড়ছে তো? ঠিক মতো পুষ্টি পাচ্ছে তো? পেট ভরে তো খাবারই খায় না, ওজনও বাড়ছে না, হাইট কেন কম, আজকের দিনে মায়েদের নানা প্রশ্ন। সেডেন্টারি লাইফস্টাইলে নিজের পেশা সামলে সন্তানকে বড় করে তোলা অনেকের কাছেই চ্যালেঞ্জিং। তার পর ছেলেমেয়ে ঠিকমতো খাবার না খেলে, রোগে ভুগলে চিন্তা আরও বাড়ে। সেই সঙ্গেই স্কুলে পাহাড়-প্রমাণ পড়াশোনার চাপ। সেইসব সামলে আবার একস্ট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির ঝক্কি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব কিছু খিচুড়ি পাকিয়ে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে যেন কোনও খামতি না হয়। সঠিক ডায়েট, নির্দিষ্ট সময় খাওয়া, শিশু অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে কিনা, কোনও রোগ ভেতরে ভেতরে বাসা বাঁধছে কিনা এইসব দেখার দায়িত্ব অভিভাবকদেরই।
শিশুর বৃদ্ধি কোন বয়সে কেমন
শিশুর বৃদ্ধি (Child Growth) চারটি পর্যায়ের উপর নির্ভর করে। এক, জন্মের পর, দুই, স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগের সময়, তিন, স্কুলজীবনের মধ্যবর্তী সময় এবং চার, স্কুল পাস করার পরবর্তী সময় থেকে বয়ঃসন্ধি অবধি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রসবের আগে গর্ভে শিশুটির যা ওজন থাকে জন্মের পরে সেই ওজনের ৫% থেকে ১০% কমে যায়। কিন্তু দু’সপ্তাহ পর থেকে ফের ওজন বাড়তে থাকে। ৪ মাস থেকে ৬ মাস বয়স অবধি শিশুর ওজন তার জন্মের সময়ের ওজন থেকে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এর পরবর্তী সময় ওজন একটানা বাড়ে না। আবার এক থেকে দু’বছর বয়স অবধি ওজন প্রায় ২ কিলোগ্রাম বাড়ে। পাঁচ বছর বয়স অবধি ওজন বাড়লে এই হারেই বাড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন দশ বছর বয়স অবধি শিশুর স্বাভাবিক ওজন বাড়তে দেখা যায়। অনেকের আবার ৯ বছরের পর থেকে ১৫ বছর বয়স অবধি উচ্চতা ও ওজন দুই সামঞ্জস্য রেখে বাড়ে। তবে খাদ্যাভ্যাস বা বংশগত রোগের কারণে অনেক সময়েই শিশু স্থূলত্ব বা ওবেসিটির শিকার হয়। তখন ওজন প্রয়োজনের থেকে বেশি বাড়ে, আবার উচ্চতা বদ্ধিও থমকে যায় নানা কারণে।
এখন দেখে নেওয়া যাক, শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে কী কী কীরণ
আরও পড়ুন: রক্তাল্পতায় ভুগছেন দেশের মা-বোনেরা, গর্ভাবস্থায় এক ভয়ঙ্কর সমস্যা, মুক্তির উপায় বললেন বিশেষজ্ঞরা
সঠিক পুষ্টির অভাব
সবচেয়ে বড় কারণ অপুষ্টি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একগাদা খাবার খাওয়ালেই যে পুষ্টি হবে তেমনটা নয়। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিশু অপুষ্টির শিকার। গ্রাম ও প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের বয়সের শিশুর বৃদ্ধিও থমকে যায়। সেখানে অপুষ্টির বড় কারণ অভাব ও দারিদ্র। কিন্তু শহরগুলিতেও অনেক শিশু অপুষ্টির শিকার। তার কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন বয়সের শিশুকে কতটা খাবার খাওয়াতে হবে তার সঠিক ধারমা নেই অনেকেরই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাচ্চা বলে প্রয়োজনের অনেক কম খাবার খাওয়াচ্ছেন মা। দুটো মিলের মধ্যে সময়ের ফারাক থাকছে অনেক। আবার এমনও দেখা গেছে, খুব সময়ের ব্যবধানে বারে বারেই একগাদা খাবার খাওয়ানো হচ্ছে শিশুকে। যার ফলে হজমে সমস্যা হচ্ছে, বমি করছে শিশু, কম বয়সেই গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর বিকাশ ঠিকমতো না হওয়ার এগুলিও অন্যতম কারণ। অনেক শইশুরই দুধ সহ্য হয় না। তার জন্য বিকল্প উপায় আছে। তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতোই ডায়েট ঠিক করা উচিত।
নিউরোলজিক্যাল কারণ থাকতে পারে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবার খেতে সমস্যা হয় অনেক শিশুর। মুখে খাবার নিয়ে বসে থাকতে দেখলে মায়ের রাগারাগি করেন। কিন্তু যদি একটানা এই সমস্যা হতে থাকে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ওরাল সেনসিটিভিটি একটা বড় কারণ। তাছাড়া স্নায়বিক সমস্যাও থাকতে পারে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। শিশু যদি সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত হয় তাহলেও বৃদ্ধিতে তার প্রভাব পড়ে।

ঘন ঘন বমি, অ্যাসিড রিফ্লাক্স বড় সমস্যা
অনেক বাচ্চারাই খাবার খাওয়ার পরে বমি করে দেওয়ার প্রবণতা থাকে। দুষ্টুমি করছে ভেবে বকাবকি না করে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা উচিত বলেই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অ্যাসিড রিফ্লাক্সের কারণে শরীরে অস্বস্তি হতে থাকে। খাবার খেলেই গা গুলিয়ে ওঠে। তাই বমি করে দেয় বাচ্চারা। খাবার ঠিকমতো পাকস্থলীতে না গেলে পুষ্টিও হয় না। অ্যাসিড রিফ্লাক্স খুবই সাধারণ সমস্যা এবং বিভিন্ন সময় প্রায় সকলেই এই কমবেশি এই সমস্যায় ভুগে থাকে। অ্যাসিড রিফ্লাক্স হওয়ার ফলে যে প্রদাহ ও অস্বস্তি তৈরি হয় তার থেকে খাদ্যনালী বা ইসোফেগাস সঙ্কুচিত হয়ে যায়। এর ফলে গলায় অস্বস্তি, বমি ভাব, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্টর মতো সমস্যা দেখা দেয়। গলার কাছে কিছু আটকে থাকার মতো অনুভূতি হতে থাকে। বাচ্চাদের যদি এই সমস্যা দেখা দেয় তাহলে সাবধান হতে হবে।
তলে তলে থাইরয়েড বাসা বাঁধছে না তো
জন্মগত রোগ হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জন্মের ঠিক পরেই সমস্যাটা বোঝা যায় না। কিন্তু সেই সমস্যার জেরে ভুগতে হয় আজীবন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোনের নিঃসরণ স্বাভাবিক না হলে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি দুই থমকে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগের নাম কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম বা সি এইচ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মের পরে সদ্যোজাতদের মধ্যেও সি এইচের উপসর্গল দেখা গেছে। এক্ষেত্রে শিশুদের জিভ বড় হয়, গলার স্বর অনেক কর্কশ হয়, জন্মের পরেই জন্ডিসে আক্রান্ত হয় অনেক শিশু। সি এইচ থাকলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না। বুদ্ধির দিক থেকেও পিছিয়ে থাকে শিশু। ঠিকমতো কথা বলতেও সমস্যা হয়। থাইরয়েডের সমস্যা পরবর্তী সময়েও হতে পারে। গলা ফুলে যাওয়া বা ওজন বেড়ে যাওয়া এর উপসর্গ হতে পারে। তাই শিশুদের নিয়ম করে রুটিন চেক আপ করানো প্রয়োজন।

ভাল থাক শিশুর হৃদয়
কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ সবচেয়ে বড় সমস্যা। জন্মগতভাবে হার্টের রোগ থাকলে শিশুর বিকাশ ঠিকমতো হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনজেনিটাল হার্ট ডিফেক্ট হলে শ্বাসের সমস্যা হতে থাকবে শিশুর, ত্বকের রঙে বদল আসবে, খাবার খাওয়ার সময় শ্বাস নিতে সমস্যা হবে। শরীরে রক্তচাপের হেরফের হতে পারে। অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে শিশু। খেলাধূলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। মাঝে মাঝেই জ্ঞান হারাবে। ঝিমুনি বেশি হবে। এইসব উপসর্গ দেখে সাবধান হতে হবে।
বাড়ছে জনসংখ্যা, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপুষ্টি
ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, ২০১৯ সালের প্রথম দিনে ভারতে ৬৯ হাজার ৯৪৪ জন নবজাতকের জন্ম হয়েছে। শিশু জন্মের হারে ১৩০ কোটির ভারত বছরের প্রথম দিনটিতে চিনকেও টপকে যায়। চিনের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ছিল ৪৪ হাজার ৯৪০। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দারিদ্র্য, অনাহার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার-এর রিপোর্ট বলছে, বিশ্ব জুড়ে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রায় ৬১ কোটি মহিলা রক্তাল্পতায় ভোগেন। আর আমাদের দেশের নিরিখে তা প্রায় ৫১ শতাংশ। ২০১৭ সালের ‘গ্লোবাল নিউট্রিশন রিপোর্ট’ অনুযায়ী, প্রজননক্ষম মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতায় আক্রান্তদের সংখ্যা অত্যধিক। প্রত্যন্ত এলাকাগুলো শুধু নয়, শহর থেকে শহরতলি–অনেক মহিলাই গর্ভবতী অবস্থায় সঠিক চিকিৎসা এবং পরিচর্যা পাননা। যার প্রভাব পড়ে গর্ভস্থ ভ্রূণ ও নবজাতকের উপর।
২০০৫-০৬ সালে দেশের ৫ বছরের কমবয়সী শিশুর ৭০ শতাংশ ছিল অপুষ্টিজনিত রোগের শিকার। ২০১৫-১৬ সালে দেশের ১৭টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই হার ৩৮-৭৮ শতাংশের মধ্যে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষাও বলছে, দেশে পাঁচ বছরের নীচে থাকা প্রায় ৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে সাত কোটি শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। বয়সের তুলনায় ওজন কম সাড়ে চার কোটি শিশুর। যার মূল কারণ অপুষ্টি। হিমোগ্লোবিনের অভাবে এই শিশুরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে সহজে। রোগের শিকার হয়। অপুষ্টির কারণে এদের মস্তিষ্কেরও পূর্ণ বিকাশ ঘটে না। পরিসংখ্যান বলছে, মায়েদের মাত্র ৯ শতাংশ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে এসে স্বাস্থ্যচেতনার পাঠ পান। মা সারা দিন বাড়িতে কতটা সুষম আহার খাচ্ছেন বা শিশুকে দিচ্ছেন, সেটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দামি দামি খাবার খেতে হবে, তা নয়, বরং সস্তার কোন খাবার খেলে কতটা পুষ্টি হতে পারে, তা মায়েদের জানানো খুবই দরকার। শুধু তা-ই নয়, সেই খাবার গ্রহণের ঠিক পদ্ধতি জানানোও একান্ত আবশ্যক।