
ৰেঙ্গলওয়াজ ব্যুরো , পূর্ব বর্ধমান: বামের প্রত্যাবর্তন। বাম অর্থাৎ বামদেব মণ্ডল। একসময়কার দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল কংগ্রেস নেতা। গত কয়েকবছর যিনি দলের গোষ্ঠীবিন্যাসে ম্রিয়মান হয়ে পড়েন। কিন্তু সদ্য ঘোষণা হয় জেলা কমিটিতে আবার গুরুত্ব ফিরে পেয়েছেন বামদেব। এই নিয়ে বুধবার দিনভরই রায়নার রাজনীতি সরগরম।
একসময় রায়না এলাকার সিপিএম নেতা ছিলেন বামদেব। প্রতাপ ছিল তাঁর। কিন্তু মূলত রায়না এলাকার বালিখাদের নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য নানা ইস্যুতে তাঁর সঙ্গে দলের সংঘাত শুরু হয়। রায়নায় তখন দাপট সিপিএমের জেলা নেতাদের বেশ কয়েকজনের ঘনিষ্ঠ কওসের আলির। কওসের আলি আবার ঘনিষ্ঠ ছিলেন তদানীন্তন জেলা সভাপতি উদয় সরকারের। এই বিবাদে তাঁরা আবার সমর্থন পান তৎকালীন জেলার সর্বেসর্বা অমল হালদারের। সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হন বামদেব।
ধীরে ধীরে রায়নার নানা এলাকায় সিপিএমের বাঁধন আলগা হতে থাকে। একের পর এক গ্রামে মজবুত ঘাঁটি তৈরি হয় তৃণমূলের। সিপিএম অবশ্য সহজে জমি ছাড়েনি। একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে। দু’ দলের বেশ কয়েকজন কর্মী খুন হন। পুলিশের গুলিতে মারা যান দু’জন তৃণমূল কর্মী। এই এলাকায় কান পাতলেই তখন নানা গুজব। কোনও কোনও এলাকা কার্যত মুক্তাঞ্চল। পুলিশকে কোথাও আটকাচ্ছে জনতা। কোথাও সিপিএমের অফিস দখল হয়ে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে এই এলাকায় ভাল ভোট পায় তৃণমূল। অথচ পাঁচের দশক থেকে এখানে বামেদের একচ্ছত্র আধিপত্য। সেই এলাকা হাতছাড়া হতে দিতে চায়নি সিপিএম। তারা তাদের সব জোর প্রয়োগ করে। গ্রামে গ্রামে বারবার হানা দেয় পুলিশবাহিনী। এমনকি বর্ধমানে আহত তৃণমূল কর্মীকে দেখতে গিয়ে আক্রান্ত হন বর্ধমানের জনপ্রিয় তৃণমূল নেতা সমীর রায়। ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে। বর্ধমানে রোড র্যালি করতে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লালদুর্গ বর্ধমান সেদিন সবুজের প্লাবন দেখেছিল। সেই সভা থেকেই সিঙ্গুরে একমুঠো করে চাল নিয়ে যাওয়ার ডাক দেন মমতা।
ওদিকে গ্রামে গ্রামে তখন বামদেবের জয়যাত্রা। একটা সময় পুলিশ তাঁকে ধরতে মরিয়া হয়। কিন্তু কোথায় যে বামদেব আত্মগোপন করে আছেন তার হদিশ মেলেনি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বামদেবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর সমর্থনে সেদিন পথে নামেন বহু মানুষ। এমনকি যেদিন তিনি ছাড়া পেলেন সেদিনও তাঁর সমর্থনে বর্ধমানে ঢল নামে তৃণমূল কর্মীদের। গড় বাঁচাতে দামোদর পাড়ে সভা করতে আসেন স্বয়ং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু বামেদের গড় বাঁচেনি।
কিন্তু পরবর্তীতে বামদেবও এই প্রবল জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি। দলের নানা গোষ্ঠী মাথাচাড়া দেয়। বামদেব বনাম নিয়ামুল সংঘাতে বারবার উত্তপ্ত হয় রায়না। রায়নার বেতাজ বাদশা বামদেবের প্রতিপত্তি কমে আসে। না তিনি বিধানসভার টিকিট পান, না পঞ্চায়েত সমিতির। বরং এখানে টিকিট পেয়ে বিধানসভায় জেতেন নেপাল ঘড়ুই। সেই বামদেব, একসময় কেষ্ট মণ্ডলের পরেই যিনি হাইকম্যান্ডের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তিনিই বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন বর্ধমান শহরে।
গত কয়েকবছর বামদেব বর্ধমানে থাকতেন। চায়ের দোকান ছাড়া আর কোথাও তাকে দেখা যেত না। সেই বামদেব আবার নতুন করে রায়নার ১ নম্বর ব্লকের দলের সভাপতি নিযুক্ত হলেন। এ নিয়ে শুরু হয়েছে জোর গুঞ্জন। কারও মতে এলাকায় সংগঠনের হাল ফেরাতে বামে ভরসা রাখল দল। কিন্তু অন্য একটা শিবির মনে করছে এলাকায় তাঁর আর সেই প্রভাব নেই। বরং নতুন করে আবার গোষ্ঠী বিবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে। কেননা অনেকেরই মতে একটা অংশ হয়ত বামকে আর নেতা মানবে না।
বামদেব যদিও নতুন উদ্যমে নিজের হারানো জমি ফিরে পেতে মাঠে নেমে পড়েছেন। তিনি আবার গ্রামে তাঁর পুরনো সুহৃদদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি তো বরাবরই দলের সৈনিক। নেত্রী আমাকে মনে রেখেছেন। তাই আবার দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি মাথা পেতে নিলাম।’’
রায়নায় এখন বিজেপি বাড়ছে। সিপিএম তো আছেই। একসময় জেলার রাজনীতিতে চালু ঠাট্টা ছিল; রায়নায় এখন সবাই বাম। অর্থাৎ হয় সিপিএম নয় বামদেব মণ্ডলের সমর্থক। সে সুদিন আর নেই। বদলে যাওয়া সময়ে তিনি কি পারবেন আবার দলে জোয়ার আনতে? উত্তর জানে দক্ষিণ দামোদর।