তোপের শব্দে দুর্গোৎসব শুরু হয়ে গেল বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবাড়িতে শুক্রবার নবম্যাদি কল্প থেকে বড় ঠাকুরানি অর্থাৎ দেবী মহালক্ষীর পুজো শুরু হল। শুক্রবার সকালে রাজবাড়ি সংলগ্ন সায়রে বড়ঠাকুরানির পটের স্নান পর্ব শেষে মন্দিরে প্রবেশের পরই প্রথানুযায়ী তিন বার মূর্চ্ছা পাহাড়ে কামান দাগা হল। পরে গর্ভগৃহে প্রবেশের মুহূর্তেও হল তোপধ্বনি। দেবীকে অন্নভোগ নিবেদনের সময়ও প্রথা মেনে হল তোপধ্বনি।

বাঁকুড়া:  মল্ল রাজারা আর নেই, নেই রাজ্যপাটও। তবু ভাঙাচোরা রাজবাড়ির দেওয়ালে কান পাতলে আজও যেন শোনা যায় প্রাচীন ইতিহাসের পদধ্বনি। সেখানে ইটের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে রয়েছে কত গল্পকথা, রীতি আর ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য মেনেই শুক্রবার দুর্গোৎসবের সূচনা হল বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবাড়িতে।

পট পুজোই এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শহরের শাঁখারি বাজারের ফৌজদার পরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকতা মেনে আজও ফি বছর বড় ঠাকুরানি, মেজ ঠাকুরানি ও ছোটো ঠাকুরানির আলাদা-আলাদা তিনটি পট আঁকেন। মন্দিরে দেবী মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশেই নির্দিষ্ট জায়গায় এই তিনটি পট রেখে পুজো হয়।

শুক্রবার নবম্যাদি কল্প থেকে বড় ঠাকুরানি অর্থাৎ দেবী মহালক্ষীর পুজো শুরু হল। শুক্রবার সকালে রাজবাড়ি সংলগ্ন সায়রে বড়ঠাকুরানির পটের স্নান পর্ব শেষে মন্দিরে প্রবেশের পরই প্রথানুযায়ী তিন বার মূর্চ্ছা পাহাড়ে কামান দাগা হল। পরে গর্ভগৃহে প্রবেশের মুহূর্তেও হল তোপধ্বনি। দেবীকে অন্নভোগ নিবেদনের সময়ও প্রথা মেনে হল তোপধ্বনি।

দেবী পক্ষের চতুর্থীর দিন থেকে রাজপরিবারের মেজ ঠাকরুন অর্থাৎ দেবী সরস্বতী ও সপ্তমীর দিন থেকে ছোটো ঠাকুরানি অর্থাৎ দেবী মহাকালীর পুজো শুরু হয়। বড়, মেজো ও ছোটো ঠাকুরানি এই তিনজনই দেবী মহামায়ার রূপ হিসেবে মল্লরাজাদের হস্ত লিখিত বলীনারায়ণী পুঁথি অনুযায়ী পূজিতা হন।

৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দ, বাংলা ৪০৪ সাল। তৎকালীন রাজা জগৎ মল্ল স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর বিষ্ণুপুরে দেবী মৃন্ময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি মল্ল রাজাদের কূলদেবী। অতীতে রাজাদের আমলে যে আড়ম্বর ছিল সময়ের দাবি মেনে তাতে ভাঁটা পড়েছে। কিন্তু শহরবাসীর উৎসাহে ভাটা পড়েনি এতোটুকুও। অন্যান্য পুজো কালিকাপূরাণ মতে হলেও এই রাজ্যে একমাত্র বিষ্ণুপুর রাজ পরিবারে বলিনারায়ণী মতে দুর্গাপুজো হয় বলে দাবি। একসময় এখানে পুজোয় বলি প্রথা চালু থাকলেও রাজা হাম্বির মল্ল বৈষ্ণব মতে দীক্ষা নেওয়ার পর চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় বলি প্রথা।

শব্দকে ব্রহ্ম হিসেবে ধরে সেই সময় থেকেই পাহাড়ের উপর কামানের তোপধ্বনির চালু হয় বলে জানা গেছে। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর অষ্টমীর দিন থেকেই মন্দিরের গর্ভগৃহে অষ্ট ধাতু নির্মিত বিশালাক্ষ্মী ও নবমীর রাতে খচ্চরবাহিনী দেবীর পুজো হয়। বিজয়া দশমীতে দেবী মৃন্ময়ীর ঘট বিসর্জনের পর বড় ঠাকুরানি, মেজ ঠাকুরানি ও ছোট ঠাকুরানির ঘটও বিসর্জন হয়। সব শেষে এই তিন ঠাকুরানির পট নিয়ে যাওয়া হয় রাজবাড়ির অন্দর মহলে।

মল্লরাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য জ্যোতি প্রসাদ সিংহ ঠাকুর জানান, মহারাজ জগদমল্লের হাত ধরে ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এই পুজো শুরু হয়। পঞ্জিকা মতে সপ্তমী তিথির পুজো শুরুর ১৪ দিন আগে এখানে পুজো শুরু হয়। যদিও এ বছর ব্যতিক্রম। আশ্বিন মাসে দু’টি অমাবস্যায় পড়ে যাওয়ায় ‘মল মাস’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় এক মাস পরে আনুষ্ঠানিক পুজো শুরু হবে। কিন্তু মা মৃন্ময়ীর পুজো শুরুর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘বড় ঠাকুরানি এলেন। পর্যায়ক্রমে নিয়ম মেনে মেজো ঠাকুরানি ও ছোটো ঠাকুরানি আসবেন। অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে রাজ অঞ্জলি হবে, তোপধ্বনিও হবে। অষ্টমী-নবমীর মধ্যরাতে খচ্চর বাহিনী দেবী পুজোর প্রথা চালু রয়েছে। বিজয়া দশমীতে বিশালাক্ষ্মী দেবীর রাজগৃহে প্রবেশ ও নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর পর দইয়ের মধ্যে চ্যাং মাছ ছেড়ে পুজোর সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।’’

রাজ পুরোহিত সুপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এখানে মা লক্ষ্মী, মা সরস্বতী ও মা কালী এই তিন রূপে দেবী পুজিতা হন। এক পক্ষকালের জন্য আসেন মা জগজ্জনী। এবছর আশ্বিন মাসে মল মাস পড়ে গেছে। তাই বাড়তি ক’দিন থাকবেন দেবী।

সারা বছরের পাশাপাশি পুজোর এই দিন গুলিতে মন্দির নগরীতে বিষ্ণুপুরে পর্যটকদের ঢল নামে। প্রাচীন ঐতিহ্য আর পরম্পরার সাক্ষী থাকতে আজও জেলা, রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ ভিড় করেন। মল্ল রাজারানা থাকলেও তাঁদের কীর্তির জেরে এখনও বিষ্ণুপুরকে চিনে নেন মানুষ।