
বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এখন ঘরের বাইরে বেরোতেও মানা। বেড়াতে যাওয়ার চ্যাপ্টার আপাতত ক্লোজ। লকডাউন চলছে। বাসা-বন্দি বাঙালির প্রাণপাখি ছটফট করছে। শুয়ে, বসে, গার্হস্থ্যকর্ম সেরেও সময় যেন কাটছে না। তবুও ‘পায়ে পায়ে বাংলা’ যথারীতি প্রকাশিত হল। আপাতত ভ্রমণকাহিনি পাঠেই হোক আপামর বাঙালির মানসভ্রমণ।
কালনা ২ নম্বর ব্লকের বৈদ্যপুর পঞ্চায়েতের অন্তর্গত একটি গ্রাম নারকেলডাঙ্গা। কালনা থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে কালনা-বৈঁচি বাসে বৈদ্যপুর রথতলা স্টপে নেমে ২ কিলোমিটার উত্তরে বেহুলা নদীর তীরে অবস্থিত এই গ্রাম। নাম দেখলে সরলভাবে বোঝা যায় যে গ্রামটিতে প্রচুর নারকেল গাছ ছিল। গ্রামটি ছোট হলেও গ্রামদেবী জগৎগৌরীর জন্য এই তার খ্যাতি। মনসামঙ্গল কাব্যে এই গ্রামের উল্লেখ রয়েছে।
জগৎগৌরী বিগ্রহ কষ্টিপাথরের। দেবী সিংহের পিঠে স্থাপিত পদ্মের ওপর উপবিষ্টা এবং তাঁর বাম হাঁটু মোড়া ও ডান পা ঝোলানো। বাম কোলে একটি শিশু। দেবী সোজা বসে আছেন। মাথার ওপর অষ্টনাগ ফণা বিস্তার করে ছাতা ধরে আছে। দেবীর পদতলে একটি ছিন্ন মুণ্ডু। ভাস্কর্যের এক অপরূপ নিদর্শন বিগ্রহটি।
এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীজগৎগৌরী মাতার একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। পদ্মপুরাণ থেকে জানা যায়, জগৎগৌরীর পিতা মহাদেব। ব্রহ্মা পরমরূপসী কন্যার নাম রাখেন ‘বিষমুখ’। শেষে তাঁর নাম হল ‘বিষহরি’। এই বিষহরির দ্বারা জগতের হিতসাধন হবে এরূপ জেনে তিনি নাম রাখলেন জগৎগৌরী। নাগলোকবাসীগণ নাম রাখলেন ‘মনসা’, আবার পদ্মবনের পদ্মপাতায় জন্ম বলে তিনি পদ্মাবতী।
জগৎগৌরী মা মনসা হলেও নারকেলডাঙ্গার জগৎগৌরী দুর্গা ও মনসার মিশ্রিত রূপ। পূজায় প্রথমে জগদ্ধাত্রীর ধ্যান পরে মনসার ধ্যানমন্ত্র পাঠ করা হয়। দেবীর নিত্যপূজা ও ভোগ হয়, সন্ধ্যায় আরতি ও ভোগ হয়।
বিগ্রহপ্রাপ্তির একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। বৈদ্যপুর জমিদার বংশের মেজ নন্দীবাড়ির এক বাল্যবিধবা স্বপ্নে দেখেন নারকেলডাঙ্গার কচুবনে মা মনসার প্রতীক জগৎগৌরী রয়েছেন। স্বপ্নানুযায়ী সেই মূর্তি তুলে এনে বৈদ্যপুরের জমিদারবাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে রেখে পূজার ব্যবস্থা করা হয়। পরে দেবীকে স্থানান্তরিত করা হয় নারকেলডাঙ্গার এক ব্রাহ্মণ বাড়িতে।
গ্রামের মঙ্গলার্থে প্রতি বছরই জগৎগৌরীকে কয়েক মাইলের মধ্যে চতুঃপার্শ্বস্থ গ্রামসমূহে একবার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ফাল্গুন মাস থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত দেবী গ্রাম পরিভ্রমণ করেন। জ্যৈষ্ঠের কৃষ্ণাপঞ্চমীতে (দশহরার পরের পঞ্চমী) নারকেলডাঙ্গায় ঝাঁপান হয়। আষাঢ় মাসের শুক্লাপঞ্চমীতে দশহরার পর জগৎগৌরী মাতার বিশেষ পূজা হয় যেটি ঝাঁপান উৎসব নামে পরিচিত। ঝাঁপান শব্দের অর্থ ডুলি, বহনমঞ্চ। দেবীকে ডুলিতে বা চতুর্দোলায় চড়িয়ে ইতস্তত ঘোরানো হয় বলে উৎসবটির নাম হয়েছে ঝাঁপান উৎসব। এটি এখানকার সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত উৎসব।
ঝাঁপানের আগের দিন দেবীর রাজবেশ এবং অধিবাস হয়। ঝাঁপানের দিন কচুদহের পরিত্যক্ত মন্দিরে দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাতে ফিরিয়ে আনা হয়। সারাদিন ধরে পূজাপাঠ চলে, সহস্রাধিক ছাগ বলির ফলে মন্দির চত্বর রক্তে ভেসে যায়। দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর পুণ্যার্থীর আগমন ঘটে।
এই উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ ‘নাচঘর’। বৈদ্যপুর গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় নাচঘর বেরোয়। গরুরগাড়িতে বাঁশবাখারি দিয়ে মঞ্চ করে নারীবেশে বা পুরুষবেশে সমকালীন রাজনীতি অথবা স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে অনেক বিদ্রুপাত্মক গান গাইতে গাইতে নাচগান করে থাকেন। আর একটি বিশেষ আকর্ষণ হল ‘থাকা’ সাজানো। ঠাকুর সাজানোর কাঠামোর মতো বাঁশ ও বাখারি দিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি-সহ উঁচু মঞ্চ নির্মিত হয়। একেই ‘থাকা’ বলে। সুসজ্জিত মঞ্চে পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে মাটির পুতুল সাজিয়ে বাজনা বাজিয়ে নাচতে নাচতে ঝাঁপানতলায় আনা হয়। ‘থাকা’-র বিষয়বস্তু কখনও রামরাজাপালা, রাইরাজাপালা, শ্রীকৃষ্ণের দোললীলা, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণপালা ইত্যাদি। দুপুরবেলা সব ‘থাকা’ ঝাঁপানতলায় সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। দর্শকরা বিচার করেন কোনটি সবচেয়ে ভাল। ঝাঁপান উৎসবের পরদিনও কিছু উৎসব চলে। এই দিনের পূজাকে বলা হয় ‘পাল্টা পূজা।’ মোট তিন দিনের উৎসবে জগৎগৌরীর ঝাঁপান সমাপ্ত হয়।
ঝাঁপান উপলক্ষ্যে বিরাট মেলা বসে। মেলায় আম, কাঁঠাল ও আনারসের প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও নানা দ্রব্যাদির আমদানি হয়ে থাকে। বর্ষাকাল বলে নদীনালা, পুকুর, খাল-বিলে মাছ ধরার নানান সরঞ্জাম যেমন জাল, ঘূর্ণি, কোঁচ ইত্যাদির আকর্ষণ খুব বেশি থাকে।
নারকেলডাঙ্গার কাছেই উদয়পুর গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বেহুলা নদী। নদীর ধারে চাঁদসদাগর খ্যাত বেহুলা দেবীর মন্দির রয়েছে।
গোপালদাসপুর
বৈদ্যপুর থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে অবস্থিত গোপালদাসপুর গ্রাম। এখানকার বিশেষ দ্রষ্টব্য হল প্রায় সাড়ে সাত বিঘা জায়গা জুড়ে এক মন্দির প্রাঙ্গণ। এই মন্দির আলো করে রয়েছেন রাখালরাজা। শ্রীকৃষ্ণের একাধিক লীলার মধ্যে অন্যতম হল গোষ্ঠীলীলা। এখানে শ্রীকৃষ্ণ রাখাল সেজে তাঁর পারিষদ, সঙ্গীসাথিদের সঙ্গে লীলা করেন। মন্দিরটি প্রায় শতাধিক বৎসরের প্রাচীন। এই প্রাচীন মন্দির ঘিরে এক অলৌকিক ঘটনা আজও জনপ্রিয় হয়ে রয়েছে।
কাটোয়ার খাটুন্তি গ্রামের বাসিন্দা রামকানু গোস্বামী পারিবারিক অশান্তির কারণে পত্নী ও ইষ্টদেবতা গোপীনাথকে নিয়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন। পথে গোপালদাসপুরে বিশ্রামকালে ব্রাহ্মণ রাত্রে স্বপ্নে দেখেন, রাখালবেশী গোপাল তাকে বলছে-– ‘‘বৃন্দাবন যাবার দরকার নেই। গোপালদাসপুরেই বৃন্দাবন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আমি এখানেই থাকব, এখানে আমাকে নিত্যসেবা দিবি। সামনেই যে জলাশয়, যার নাম ‘যমুনা’ সেখানে যে কাঠ ভাসছে সেই কাঠ দিয়ে বিগ্রহ তৈরি করে আমার পূজা কর।’’ স্বপ্ন ভেঙে উঠে তিনি জলাশয়ের কাছে যান এবং দেখেন সত্যি সত্যি কাঠ ভাসছে। বাঘনাপাড়ার গোপাল নামের সূত্রধরকে দিয়ে বৃন্দাবনের রাধাকান্তের অনুরূপ (রাখালবেশী, হাতে বাঁশি) বিগ্রহ নির্মাণ করান। বিগ্রহের নাম হয় রাখালরাজা। ভিক্ষা করে আনা সামগ্রী দিয়ে চলতে থাকে রাখালরাজার সেবা। যমুনা বর্তমানে একটি ছোট পুকুর (গাঙুর নদীর যমুনা নামক খাতে)।
সময়টা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দী। নারকেলডাঙা-গোপালদাসপুর দিয়ে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার পথ ছিল। বাংলায় তখন মুর্শিদকুলি খাঁর রাজত্ব। ওই পথ দিয়ে যেতে যেতে তিনি কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে রাখালরাজার পর্ণকুটিরের সামনে উপস্থিত হন। রাখালরাজাকে দর্শন করে এবং প্রসাদে আপ্যায়িত হয়ে তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা ও সারা বছর পূজার্চনার জন্য গোপালদাসপুরে সাতশো বিঘা নিষ্কর দেবোত্তর সম্পত্তির ব্যবস্থা করে দেন। গড়ে ওঠে রাখালরাজার মন্দির।
জোড়বাংলা পদ্ধতিতে এই মন্দির নির্মিত হয়। দুটি পাশাপাশি দোচালা কুটিরকে জোড়া করে এই মন্দির, কোনও শিখরদেশ নেই। ভেতরের অংশে রয়েছে গর্ভগৃহ এবং তার সন্মুখভাগে অর্ধমণ্ডপ। মন্দিরটি মাটি থেকে ৪ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এবং দক্ষিণমুখী। সামনে একটি নাটমণ্ডপ আছে। নাটমণ্ডপটি দাঁড়িয়ে আছে ১২টি থামের ওপর যে থামগুলিতে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের লীলা সম্বলিত চিত্র। মন্দির অভ্যন্তরে রয়েছে গোপীনাথ ও রাখালরাজের দারুবিগ্রহ। গোপীনাথ ত্রিভঙ্গঠামে দণ্ডায়মান বংশীধারী কৃষ্ণ। রাখালরাজ গোচারণরত শ্রীকৃষ্ণ সোজাভাবে দণ্ডায়মান। বিগ্রহদের পূজা চলাকালীন ওই নাটমন্দিরে চলতে থাকে নামসংকীর্তন। প্রায় ৪০০ জন লোক একসঙ্গে বসার সুযোগ আছে নাটমন্দিরে।
প্রতিবছর মাঘ-ফাল্গুন মাসে রাখালরাজের অঙ্গরাগ হয়। তার পর হয় অভিষেক। রাখিপূর্ণিমার দিন অভিষেক হয়। নাটমন্দিরের ১০ ফুট পূর্ব দিকে মন্দিরের আদলে তৈরি অভিষেকের জায়গা। মন্দিরের ১০০ ফুট সামনে গিরিগোবর্ধনের মন্দির। মন্দিরে একটি গরু শায়িত অবস্থায় আছে। কালী পূজার পরের দিন প্রতিবছর গো-পার্বণ উপলক্ষ্যে গোবর্ধন পূজা হয়ে আসছে। বছরের বিশেষ দিনে বিশেষ পূজা হয়। জন্মাষ্টমীতে তেমন পূজা হয়। ওই দিন রাতে অন্নভোগ হয় এবং অন্নভোগের সঙ্গে কচুর শাকের ঘণ্ট অবশ্যই থাকবে। পরদিন নন্দোৎসব। এই উৎসবে সংকীর্তন তো হয়ই, তাছাড়াও নারকেল কাড়াকাড়ি, দইয়ের হাঁড়ি ভাঙা প্রভৃতি মজার অনুষ্ঠান পালিত হয়। রামনবমীর দিনে পালিত হয় রাখালরাজার দোল উৎসব। গোবর্ধন মন্দিরের পাশেই যে দোল মন্দির রয়েছে সেখানে গোপীনাথ জীউ ও রাখালরাজ ওঠেন রাজবেশ পরিহিত অবস্থায়। আগের দিন চাঁচর উৎসবে প্রচুর বাজি পোড়ানো হয়। দোল উপলক্ষ্যে মেলা বসে।
মন্দিরের পেছনে একটি বড় ইঁদারা আছে। তার জল ভোগের কাজে ব্যবহৃত হয়। এখানকার বৈশিষ্ট্য হল, কোনও ভক্ত গেলে প্রসাদ গ্রহণ না করে ফেরেন না। তবে সকাল ১০ টার মধ্যে গেলে সুবিধা হয় সেবাইতগণের পক্ষে। রাখালরাজা এ অঞ্চলের জাগ্রত দেবতা। ভক্তদের বিশ্বাস, তিনি রাত্রে এখানে গোচারণ করেন তাই মন্দির চত্বরে কারও থাকা নিষেধ।
এ তো গেল ভক্ত ও দেবতার সংবাদ। এসব বাদ দিয়েও জায়গাটি গাছপালায় ঘেরা এক মনোরম স্থান। নাটমন্দিরকে ঘিরে রেখেছে বট, অশত্থ, বেল, বকুল ও তমাল। আছে ফাঁকা প্রান্তর, নাটমন্দিরের পশ্চিমে বড়সড় খেলার মাঠ। শীতকালে দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন পিকনিক করতে। জায়গাটিতে পৌঁছলে একলহমায় মন ভাল হয়ে যায়।
কালনায় রাত্রিবাস করে দেখে নেওয়া সুবিধার হবে। রাত্রিবাসের ঠিকানা– হোটেল প্রিয়দর্শিনী, কালনা, চলভাষ : ৯৭৩২০৭৬৬৯০।