
ব্যুরো: আচমকা পুলিশি খোঁজখবরে চমকে গেছিলেন তিনি। পুলিশ খবর নিয়েছিল, ১৫ বছর আগে তাঁর হারিয়ে যাওয়া ‘পাগলি’ বোনের। তখনও তিনি জানতেন না, দিন কয়েকের মধ্যে কী অপেক্ষা করছে। আজ, রবিবার বিকেলে সেই বোনকে ফিরিয়ে দিল ‘স্টেট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি, ওয়েস্ট বেঙ্গল’। দেড় দশক পরে পরিবারের সঙ্গে মিলন হল লক্ষ্মী পাড়ুইয়ের। আর ফ্রেজারগঞ্জ এলাকার এই ঘটনার আড়ালে রয়ে গেল এক দুর্দান্ত চেষ্টা ও সমন্বয়ের গল্প।
ফ্রেজারগঞ্জ থানার ওসি রাজু বিশ্বাস টেলিফোনে দ্য ওয়ালকে জানালেন, তিনি দিন কয়েক আগে কাকদ্বীপের অ্যাডিশনাল ডিসট্রিক্ট জাজ তথা কাকদ্বীপের সাবডিভিশনাল লিগাল সার্ভিসেস কমিটির চেয়ারম্যানের কাছ থেকে এক মহিলার খোঁজ নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশ পান। অফিসার জানতে পারেন, মহিলার বয়স ৫৫, নাম পার্বতী পাড়ুই। ‘খোলাঘাট’ গ্রাম থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বকখালির কাছেই নাকি সে গ্রাম।
রাজু বাবু এবং থানার অন্য অফিসাররা পড়েন মহা ফাঁপরে। খোলাঘাট বলে কোনও গ্রাম নেই এলাকায়। তা বাদেও, যত পুরনো নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ছানবিন করতে থাকেন, পার্বতী পাড়ুই বলে কারও কোনও হদিসই মেলে না। প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার মতোই অবস্থা।
শেষ চেষ্টা হিসেবে এলাকাবাসীদের মধ্যে পাড়ুই পরিবারগুলিতে একবার আলাদা করে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন তিনি। তখনই দক্ষিণ শিবপুর গ্রাম থেকে একটা তথ্য আসে, বছর ১৫ আগে গোপাল পাড়ুইয়ের বোন হারিয়ে গিয়েছিলেন বসিরহাট থেকে। মানসিক সমস্যা ছিল সেই ৩৫-৪০ বছরের তরুণীর। অনেক খুঁজেও সন্ধান মেলেনি তাঁর। কিন্তু পার্বতী নয়, তাঁর নাম ছিল লক্ষ্মী পাড়ুই।
তা সত্ত্বেও অনুমানের উপর ভিত্তি করেই সেই হারিয়ে যাওয়া তরুণীর ছবি-সহ রিপোর্ট জমা করেন বিচারকের কাছে। সেই ছবিই পৌঁছে যায় ছত্তীসগড়ের বিলাসপুর স্টেট মেন্টাল হাসপাতালে। এই হাসপাতাল থেকেই আসলে এই পুনর্মিলনের কাহিনির পটভূমি শুরু হয়েছিল।
মাস তিনেক আগে বিলাসপুরের এই মানসিক হাসপাতালেই সুস্থ হয়ে ওঠা ৫৫ বছরের এক প্রৌঢ়া বলতে শুরু করেন, তাঁর নাম পার্বতী পাড়ুই, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার বকখালির কাছে খোলাঘাটা গ্রামে থাকতেন তিনি। সেখান থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলেন বলে জানান। তবে কী ভাবে ছত্তীসগড় চলে এলেন, তা অবশ্য বোঝা যায়নি।
সে যাই হোক, ওই মহিলার কথা শোনার পরেই ছত্তীসগড়ের স্টেট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি মারফত এই ঘটনাটির কথা জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গের স্টেট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটিকে। সেখান থেকে ঘটনাটি জানানো হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায়, জেলা থেকে কাকদ্বীপ সাবডিবিশনে জানানো হয় ভদ্রমহিলার কথা। এর পরেই কাকদ্বীপ আদালতের তরফে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয় এলাকা জুড়ে। ফ্রেজারগঞ্জ থানাতেও নির্দেশ যায় আদালতেরই উদ্যোগে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে কোনও সূত্র মেলেইনি প্রায়। আরও কিছু দিন পরে জানা যায়, গোপাল পাড়ুইয়ের কথা। এর পরে সমন্বয়ের কাহিনি বড়ই মধুর। ছত্তীসগড়ে রিপোর্ট ও ছবি পাঠানোর পরেই পার্বতী নামের ওই মহিলা চিনতে পারেন ছবিটি।
শেষমেশ স্টেট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটির তত্ত্বাবধানেই ছত্তীসগড় থেকে পশ্চিমবঙ্গে আনা হয় লক্ষ্মী পাড়ুই ওরফে পার্বতীকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় পৌঁছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডিস্ট্রিক্ট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটির হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁরাই পৌঁছে দেন দক্ষিণ শিবপুরের দাদা গোপাল পাড়ুইয়ের বাড়িতে।
এত বছর পরে দাদা ও বোন দুজনেই দুজনকে সামনে থেকে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েন। ১৫ বছর পরে এক অভূতপূর্ব পুনর্মিলনের সাক্ষী হতে পেরে সকলেই শিহরিত। প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার মুখ থেকেও খানিক চেষ্টা করলে যে কত বড় অসাধ্য সাধন করা যায়, তারই দৃষ্টান্ত গড়ল কাকদ্বীপ।