
ব্যুরো: করোনা কালে অন্দরবাসে মন খারাপ হলেও পেট কিন্তু থেমে নেই। ভাল-মন্দ গপাগপ পাকস্থলীতে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। মেলামেশা যখন বন্ধ তখন পেটপুজোতেই মন দিয়েছে মানুষজন। সকাল থেকে রাত ডায়েটের নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে কখনও মুচমুচে স্ন্যাকস, কখনও ইউটিউব দেখে বাড়িতেই একগাদা ঘি-মাখন ঢেলে বিরিয়ানি বা ঝাল ঝোলে ভেজানো চর্বিযুক্ত মাংস, রোল-চাউমিন-ফ্রাই কচাকচ ছুড়ি-কাঁটায় রসনাবিলাস চলছেই। ডাল-ভাতের বাঙালি অন্দরবাসের একঘেয়েমিতে একটু বেশিই ভোজনরসিক হয়ে উঠেছে। যার ছাপও পড়ছে শরীরে। পাকস্থলী বিদ্রোহ করছে, গলা-বুক জুড়ে জ্বালাপোড়া, অন্ত্রও শান্তি চেয়ে বলছে ‘আর না!’ একে তো ভীষণ স্বাস্থ্য সঙ্কটে মন ভাঙছে, অন্যদিকে অবাধ্য রসনাকে তৃপ্ত করতে গিয়ে শরীরের বারোটা বাজছে। সবমিলিয়ে শরীর যেন রোগের ডিপো হয়ে উঠছে।
ডায়েট যখন ঠিকভাবে মানা যাবেই না, তখন শরীরকে বাগে আনতে একটু কৌশল করতে হবে বইকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবসময় খাই খাই বন্ধ করতে পারছেন না যাঁরা তাঁদের জন্য হাল্কা স্ন্যাকস বেশ ভাল। ফলপাকুড়ে মন না ভরলে একটু কুড়মুড়ে স্ন্যাকস চলতেই পারে। তার সঙ্গে অরুচি কাটানোর মতো পানীয়। বিকেলের জলখাবার হোক বা প্রাতরাশ ও লাঞ্চের মাঝের সময় এই ধরনের হাল্কা খাবারে মনও ভরবে এবং অম্বল বুকজ্বালার হাত থেকে রেহাইও মিলবে। দুপুরের খাবারে একগাদা মাছ-মাংস পেটে ঢুকলে আইঢাই ভাব কমাতেও এমন স্ন্যাকস বেশ উপকারি।
মুচমুচে স্যালটিনে ক্র্যাকারে কামড় বসিয়ে হাল্কা চুমুক জিঞ্জার এইলে
স্যালটিন ক্র্যাকার পছন্দ করেন অনেকেই। বাড়িতে রোজকার ক্রিম ক্র্যাকারে মন না ভরলে নিমকি-ফুচকা এগুলোর বদলে নোনতা কুড়মুড়ে স্যালটিন ক্র্যাকার চলতেই পারে। পাতলা ক্রিস্পি বিস্কুট যার নোনতা স্বাদ জিভের জন্য বটেই মনের খিদের জন্যও বেশ ভাল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খিদে পেলে আর ভাল কিছু খেতে ইচ্ছে হলে পিৎজা, বার্গারের মোহ ছেড়ে স্যালটিনে মন বসাতে পারেন। এই জাতীয় স্ন্যাকস সুস্বাদু আর ক্যালোরিও একদম কম। স্থূলত্ব বাড়াতে পারে এমন খারাপ ফ্যাট বা কোলেস্টেরলও নেই। তাই শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাঁচটা স্যালটিন ক্র্যাকারে মাত্র দেড় গ্রাম ফ্যাট থাকে, ১ গ্রাম প্রোটিন আর ১১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে। তবে স্যালটিন ক্র্যাকার যে খুব উঁচু দরের ডায়েট ফুড সেটা নয়। তবে সর্বক্ষণের খাই খাই ভাবকে শান্ত করতে আর পেট ভরাতে এর জুরি মেলা ভার।
আরও একটা পানীয়ের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা যার নাম জিঞ্জার এইল। এক ধরনের নরম পানীয় যাতে আদার ফ্লেভার থাকে। জিঞ্জার বিয়ারের মতো অত ঘন নয়, বরং স্বাস্থ্যকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, খুচরো খিদে মেটাতে জিঞ্জার এইলের সঙ্গে স্যালটিন ক্র্যাকার খুব ভাল কম্বিনেশন। পেট ভরে, অ্যাসিডিটি কমে এবং অনেক ক্ষেত্রে বমিভাব, ঝিমুনিও কমাতে সাহায্য করে জিঞ্জার এইলে। আদার ফ্লেভার থাকায় গলা ব্যথা বা সর্দি-কাশি, পেশীর ব্যথা কমাতেও উপকারি জিঞ্জার এইলে।
তবে যে কোনও খাবারের যেমন ভাল গুণ আছে, তেমনি কিছু খারাপ গুণও আছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মত জিঞ্জার এইলে ভাল কিন্তু গাদা গাদা খাওয়াটা ঠিক নয়। কারণ এর মধ্যে আদার ফ্লেভার থাকে, সরাসরি আদার রস যোগ করা হয় না। তাছাড়া প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে যেটা ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য খুব একটা ভাল নয়। যদি কারও অ্যাকিউট গ্যাসট্রাইটিস বা বাওয়েল সিন্ড্রোমের সমস্যা থাকে তাহলে জিঞ্জার এইল বেশি না খাওয়াই ভাল। তবে এর বিকল্পও আছে।
গলা-বুকে জ্বালাপোড়া কমাতে পারে আদা চা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিঞ্জার এইল না হলে গরম আদা চা মন্দ কি! বরং আদা চায়ের উপকারিতা জিঞ্জার এইলের থেকে অনেক বেশি। আদার অ্যান্টি-ভাইরাল, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ যে কোনও ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে পারে। ভিটামিন সি, ম্যাগনেসিয়াম ও অন্যান্য উপাদানেও ভরপুর আদা। এক কাপ জলে ১/৪ চামচ থেঁতো আদা দিয়ে ভাল করে ফুটিয়ে মধু মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা তো কমেই, অম্বলের জ্বালাপোড়া থেকেও রেহাই মেলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনও জটিল অস্ত্রোপচারের পরে ঝিমুনি বা বমিভাব কমাতে আদা চা খেতে বলেন ডাক্তাররা। গর্ভাবস্থায়, কেমোথেরাপি চলবে বা অন্য সার্জারি হলে আদা চা খুব ভাল পথ্য। তাছাড়া নিয়মিত আদাল চা খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে, ব্লাড ক্লট বা রক্ত জমাট বাঁধার ভয় থাকে না। কোলেস্টেরলও কমে, ওবেসিটি কমাতে সাহায্য করে। টাইপ-টু ডায়াবেটিসের রোগীদের ইনসুলিন ও ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণে রাখে। তবে চায়ে কতটা আদা দেওয়া ভাল এবং কতবার খাওয়া ভাল সেটা শরীর বুঝে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো খাওয়াই উচিত। করোনা কালে নিজে নিজে বাহাদুরি দেখিয়ে ভেষজ ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট প্রচুর পরিমাণে খেয়ে ফেলে বিপত্তি বাঁধিয়েছেন অনেকেই।
পেট গুরগুর, বমিভাব কমাতে ডায়েটে থাক পুষ্টিকর খাবার
সুস্থ শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদান হল ভিটামিন, প্রোটিন, মিনারেলস, ফাইবার। যেসব খাবারে এই সব গুণ আছে তাদের বলে ‘সুপার ফুড’ বা ‘ইমিউন বুস্টার ফুড’। অর্থাৎ যে খাবার শরীরকে চাঙ্গা ও ঝরঝরে করে তোলে। ভেতর থেকে মজবুত ও রোগ প্রতিরোধী করে তোলে। মেপে না খেলেই কোলেস্টেরল–ট্রাইগ্লিসারাইড, ফ্যাটি লিভার বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রসেসড মিট বেশি খেলে পাকস্থলিতে কিছু ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়া দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করে৷ অতিরিক্ত চিনি দেওয়া সফট ড্রিঙ্কস এবং অবশ্যই বেশি মাত্রায় অ্যালকোহল বিপাকের হার কমায়, শরীরে মেদ জমতে শুরু করে হুহু করে। প্রচণ্ড খিদের মুখে হাই ক্যালোরি ভাজা বা প্রসেসড ফুডের আসক্তি বাড়ে৷
ভাজাভুজি না খেয়ে মন শক্ত করে ডায়েটে রাখুন পুষ্টিকর খাবার। খাবারের মোট ক্যালোরির ২৫ শতাংশ প্রোটিন থেকে এলে ভুলভাল খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। শাকসবজি, ফল, ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার থাকুক রোজকার ডায়েটে। সফট ড্রিঙ্কস, অ্যালকোহল থেকে অবশ্যই দূরে থাকা উচিত। ড্রিঙ্ক করলেও ধীরে ধীরে করা ভাল। সঙ্গে রোস্টেড বাদাম, স্যালাড, চিজ–পাইন্যাপেল রাখা উচিত। স্যালাড–ফলের গ্লুকোজ ক্রেভিং কম রাখতে সাহায্য করে৷ রেড মিট কমিয়ে বরং লিন মিট ডায়েটে থাকলে ভাল। চিকেন ছাড়াও লিন প্রোটিনের অন্যতম উৎস মাছ। প্রোটিনের পাশাপাশি মাছে রয়েছে ভিটামিন ডি ও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যা মস্তিষ্ককে তরতাজা রাখতে সাহায্য করে। লিন মিটে কোলেস্টেরল ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণও অনেক কম।